সুড়ঙ্গ      

  • 14 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 210 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
হেমন্তের নরম রোদ সকালটাকে মোহময়ী করে তুলেছে। সকালের রাউন্ড দেওয়াটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে সুনেত্রার কাছে। বেশির ভাগ মেয়েই এখনো বিছানা ছাড়েনি। আলস্য গায়ে মেখে বালিস আঁকড়ে পড়ে আছে। চায়ের ঘণ্টা বাজলে তবে উঠবে। একটা ঘরের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ভিতর থেকে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে মেয়েটি- দরজা খোলো-ও-ও!... কারাবন্দি রেহেনার গল্প।

 হেমন্তের নরম রোদ সকালটাকে মোহময়ী করে তুলেছে। সকালের রাউন্ড দেওয়াটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে সুনেত্রার কাছে। বেশির ভাগ মেয়েই এখনো বিছানা ছাড়েনি। আলস্য গায়ে মেখে বালিস আঁকড়ে পড়ে আছে। চায়ের ঘণ্টা বাজলে তবে উঠবে। একটা ঘরের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ভিতর থেকে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে মেয়েটি- দরজা খোলো-ও-ও!

  • কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন? সুনেত্রা বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলল।
  • একটা ছুরি চাই! খুব দরকার!   


মেয়েটির নাম রেহেনা। দু দুবার পালাতে গিয়েও পারেনি। দুবারই ধরা পড়ে গেছে। ঠাঁই হয়েছে বদ্ধ কুঠুরিতে। তার কেবল একটাই দাবি- একটা ছুরি। যাকে দেখতে পায় তার কাছে কাকুতি মিনতি করে একটা ছুরির জন্য।

 

 সুনেত্রা মেয়েদের এই হোমটিতে নতুন। মাত্র তিন মাস হল হোম মাদার হিসাবে কাজে জয়েন করেছে। রেহেনার ইতিহাস সে শুনেছে- সাত মাস আগে এখানে এসেছে। এর আগে হাওড়া স্টেশনে একজনকে খুন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। লক আপে থাকার সময় তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। উল্টো-পাল্টা বকে। গায়ে কাপড় চোপোড় রাখেনা। খাবার ফেলে দেয়। কেউ সামনে গেলে তাকে আক্রমণ করে। দুজন কনেষ্টবলকে কামড়েও দিয়েছিল। হোমের মানসিক চিকিৎসায় কিছুটা ফল হয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয়না, জীবনের চরম কোন বিপর্যয় রেহেনাকে এই পরিণতিতে পৌঁছে  দিয়েছে।

 

 অফিসে এ সময় কেউ থাকেনা। সেখান থেকে চাবি এনে লোহার দরজাটা খুলে দিল সুনেত্রা।  জানতে পারলে মাদার ইন চার্জ সাহানাদির কাছে বকুনি খেতে হবে। জেনে বুঝেই একাজ করল সে। রেহেনার ব্যাপারটা জানতে হবে। কি হয়েছিল তার সাথে? লোহার দরজার পরেও গ্রীলের একটা দরজা আছে। যারা বেশি গোলমাল করে তাদের এমন ঘরে রাখা হয়। গ্রীলের দরজার সামনে সুনেত্রাকে দেখতে পেয়ে রেহেনা এগিয়ে এল। গ্রীলে থুতনি ঠেকিয়ে বলল- দাও না একটা ছুরি? দাও? দাও?

- ছুরি নিয়ে কি করবে?

- একটা নেকড়ে মারব। নাহলে সে সুর্মাকে খেয়ে ফেলবে! সুর্মা ভয়ে কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছনা?

- সুর্মা কে?

- সুর্মাকে চেনোনা? আমার মেয়ে? তার খুব বিপদ! একটা ছুরি হলেই সব বিপদ কেটে যায়। কেউ দিচ্ছেনা! তুমি দেবে?

- দিতে পারি। তবে তার আগে সুর্মার কথা আমাকে বলতে হবে।

- সুর্মা সব কথা আমাকে বলেছে। আমি কাউকে বলিনি।

- ভিতরের কথা কোন একজনকে বলতে হয়। তাহলে মন হাল্কা হয়।

-  ভয় লাগে। পাঁচ কান হয়ে গেলেই নেকড়েটা সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে যাবে। আর তাকে মারতে পারবনা। সুর্মার কান্নাও বন্ধ হবেনা। ওর কান্না আমি আর সইতে পারছি না। গলাটা ধরে আসে রেহেনার।

- কথা দিচ্ছি, আমি কাউকে বলবনা। তুমি নির্ভয়ে আমাকে বলতে পার।

 

 সুনেত্রার আন্তরিক ব্যবহারে কেঁদে ফেলল রেহেনা। বহুকাল পরে কেউ তার সাথে এমন ভাবে কথা বলল। চোখ মুছে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল সে। গুছিয়ে বলতে পারল না। দিন পাঁচেক ধ’রে কেটে কেটে, অগোছালো ভাবে সে যা বলল, সেগুলো  সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে এমনটা দাঁড়ায়-

 

জান দিদি! বেশ সুখেই ছিলাম। স্বামী ইয়াসিনের রোজগার কম হলেও মানুষ হিসাবে যথেষ্ট ভালো। আমার প্রতি তার ভালবাসার ঘাটতি ছিল না। কিছুদিন পর আমার মেয়ে সুর্মার জন্ম হল। আমার সুখের ঘরে ততদিনে আগুন লেগেছে। হঠাৎ করে ইয়াসিনের অসহ্য পেটের যন্ত্রণা শুরু হল। ডাক্তারবাবুর কথা মত পেটের ছবি করাতে গিয়ে ধরা পড়ল- ইয়াসিনের লিভার ক্যান্সার হয়েছে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে পুঁজিপাটা যা ছিল শেষ হল। দু বিঘে জমি, আমার গায়ের দু চারখানা গয়না সব গেল। তবু অসুখের কিনারা হলনা। শুনলাম কলকাতার সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় এর চিকিৎসা হয়। কিন্তু এই রুগীকে নিয়ে একা যেতে সাহস হয়না। ইয়াসিনের বন্ধু হাসান উপযাজক হয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। ইয়াসিনকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করল। সে নিয়মিত ইয়াসিনকে দেখে আসে। মাঝে মাঝে আমিও যাই তার সাথে ইয়াসিনকে দেখতে। এই সুত্র ধরে হাসান আমাদের বাড়ি আসে। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

 

একদিন সে আমার হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট দিয়ে বলল-ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকো। দেখতে খারাপ লাগে। এটা রাখো। ইচ্ছা না থাকলেও ফিরিয়ে দিতে পারলামনা। যদি কিছু মনে করে। সেই শুরু। তারপর সংসারের এটা সেটা জিনিস আসতেই থাকল। মুখে যাই বলি, না নিলেও যে আর চলছেনা! দুটো মানুষের পেট চলবে কীভাবে?

 

 একদিন সুর্মা তখন স্কুলে, আমি ঘরের মধ্যে কিছু একটা করছি। হাসান সোজা আমার ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একেবারে ঝাঁপিয় পড়ল নেকড়ের মত। কিছুক্ষণ আমার শরীরটাকে খুবলে খেয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি। আমি লজ্জায় ঘেন্নায় বিছানায় পড়ে পড়ে কাঁদতে থাকলাম।

 

বেশ কিছুদিন হাসান আর এলনা। ভাবলাম, ভুল করে ফেলেছে। তাই হয়তো অনুশোচনা হয়েছে। শয়তানের কি অনুশোচনা হয়? আবার সে এল। এবং প্রতিদিন সুর্মার অনুপস্থিতিতে আসতে থাকল। পাড়ার মানুষ ভাবত ইয়াসিনের খবর নিয়ে এসেছে। আমার হাসপাতালে যাওয়া হয় না। যেতে চাইলে হাসান এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায়। একদিন ওকে কিছু না বলে সুর্মাকে নিয়ে ইয়াসিনকে দেখতে যাব ঠিক করলাম। আগে কয়েকবার এসেছি। একে ওকে শুধিয়ে ঠিক পৌঁছে গেলাম।

 

ইয়াসিনকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলামনা। কি চেহারা হয়েছে? আমাদের দেখে সে বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে লাগল। শুনলাম হাসান এখন আর আসেনা। কবেই ইয়াসিনের ছুটি হয়ে গেছে। কেউ নিতে না আসার কারণে তাকে মেঝেয় ফেলে রাখা হয়েছে। সেইদিনই তাকে বাড়ি নিয়ে এলাম। দিন কতকবাদে হাসান এল একথলি বাজার নিয়ে। বলল- একটা বৈষয়িক কাজের ঝামেলার কারণে ইয়াসিনের খোঁজ খবর নিতে পারেনি। সে জন্য নাকি তার অনুতাপের শেষ নাই। তবে ডাক্তারবাবুর সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। ইয়াসিন তার দুটো হাত ধরে বলল- আমি তো আর বাঁচবনা!  দেখো, তোমার ভাবি আর সুর্মা যেন ভেসে না যায়?

- তুমি চিন্তা করোনা। আমি থাকতে ওদের ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। সে বলল।

  কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্যি। ও ছাড়া আমাদের ক্ষতি করার সাধ্য কার আছে? একমাত্র ওরই অধিকার আছে আমাদের ক্ষতি করবার। বাড়ি ফেরার পনেরো দিনের মাথায় ইয়াসিন মারা গেল।

 

 ইয়াসিনের মৃত্যু অসহনীয় হলেও কোথাও যেন একটা স্বস্তি বোধ হল। শয়তানটার হাত থেকে এবার মুক্তি মিলবে। যেমন করেই হোক মা-মেয়ের দুটো পেট চালিয়ে নেব। একজনকে ধরে পাশের গ্রামে এক বাড়িতে রান্নার কাজে লাগলাম। ভোরে উঠে বেরিয়ে যাই। ফিরতে তিনটে বাজে। সুর্মা তার আগেই স্কুল থেকে ফিরে আসে। ভাবলাম এবার বুঝি নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। মেয়েকে পড়াব। ঘরটা মেরামত করব। আমার ভবনায় ঈশ্বর মুখ টিপে হাসলেন।

 

একদিন কাজ থেকে ফিরে সুর্মাকে শুয়ে থাকতে দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল- জ্বর! গায়ে হাত দিয়ে গা ঠান্ডা দেখে বললাম- তিন সন্ধ্যে বেলায় শুতে নাই! বাইরে থেকে ঘুরে আয়। অনিচ্ছা সত্বেও সে বেরিয়ে গেল। পর দিনেও দেখলাম সুর্মা একই ভাবে কুঁকড়ে মুকড়ে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল- মা তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবে। আমার ভয় করে। কিসের ভয় বুঝলাম না। সেও খুলে বলল না। ভাবলাম, হয়তো বাবাকে স্বপ্নে দেখেছে। ছেলে মানুষ! তাতেই ভয় পেয়েছে। মৌলবি সাহেবের কাছ থেকে একটা তাবিজ আনিয়ে সুর্মার হাতে বেঁধে দিলাম। বললাম- আমি যতক্ষণ না আসব ততক্ষণ নাজিম ভাইদের বাড়িতে থাকবি। নাজিম পাড়া সম্পর্কে ভাসুরপো। নাজিম আর তার বৌ হাসিনা সুর্মাকে বোনের মত দেখে।

 

পরদিন কাজে গিয়ে কাজে মন বসাতে পারছি না। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। পাড়া ঢুকতে আগে নাজিমদের বাড়িটা পড়ে। ওখানে গিয়ে সুর্মার খোঁজ করতে হাসিনা জানালো সুর্মা আসেনি। আমার কেমন খটকা লাগল। আসেনি? বাড়ি গিয়ে দেখলাম, সুর্মা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ঘরে চেনা একটা গন্ধ! আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল! কে এসছিল? সুর্মা চুপ। আমি তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে তার গা- মাথা শুঁকতে থাকলাম। সেই আতরের গন্ধ! শয়তানটা যখন আমার কাছে আসত তখন আমি ঠিক এই গন্ধটা পেতেম। আমি এক টানে সুর্মার গায়ের জামা খুলে ফেললাম। তার সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন। প্যান্টটা রক্তে ভেজা। এবার সুর্মা আমার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। শয়তানটা ওকে শাসিয়ে রেখেছে মুখ খুললে দুজনাকেই খুন করবে। রোজ সে আসে। দশ বছরের কচি মেয়েটা ভয়ে মুখ বুজে তার নারকীয় অত্যাচার সহ্য করে।

 

 কি করি? কাকে বলি? মাথা কাজ করছেনা। গাঁয়ে জানাজানি হয়ে গেলে মেয়েটার গায়ে দাগ লাগবে। সারাজীবন সেই কলঙ্কের দাগ ওকে বয়ে বেড়াতে হবে। রান্নার কাজটা ছেড়ে দিলাম। কাছা কাছি কাজ খুঁজতে লাগলাম। মাস দুই পরে সুর্মা একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ভাবলাম বদ হজম হয়েছে। এরপর শুরু হল বমি। আমার বুঝতে বাকি থাকল না কি হয়েছে। হাসানকে গিয়ে ধরলাম। সে কিছুতেই স্বীকার খায়না। বলল, তোমার মেয়ে কোথায় কি করেছে এখন সে দায় আমি নেব কেন? আমি তাকে বললাম -আমার অনেক ক্ষতি তুমি করেছ? মেয়ের ব্যবস্থা না করলে তোমার সব কুকীর্তি ফাঁস করে দোবো। শুধু পেটেরটাকে খালাস করলেই চলবেনা। আধা দামে কেনা সেই দু বিঘে জমি আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

 

 পরদিন সে আমাদের দুজনকে তার চেনা এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। প্রায় দুঘণ্টা পরে মেয়েটাকে যখন ওটি থেকে বের করল। সে তখন প্রায় অচেতন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তার বললেন তিন চারদিন এমন হবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে। তিন চারদিনেও রক্ত বন্ধ হল না। এদিকে মেয়েটা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। আমি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে নার্স দিদিকে সব খুলে বললাম। তারা সুর্মাকে ভর্তি করে নিল। তার অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবু বললেন-  আনাড়ি হাতের যন্ত্রের আঘাতে ওর শরীরের ভিতর গভীর ক্ষত হয়েছে। তিনদিন চলল যমে মানুষে টানাটানি। চারদিনের দিন সুর্মা আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেল।

 আমার পৃথিবী অন্ধকার। কার জন্য বাঁচব? চোখের পানিও বুঝি শুকিয়ে গেছে। সুর্মার লাশের কাছে বসে সারা গাঁয়ের লোকদের ডেকে হাসানের কু-কীর্তির কথা বলব বলে ঠিক করলাম। অলক্ষে কেউ যেন আমার মুখ চেপে ধরে বলল- এখন নয়। আগে মেয়েটার শেষ কাজ মিটে যাক! নয়তো মেয়েটাকে সবাই অপবিত্র ভাববে। আমার সুর্মা ফুলের মত পবিত্র। তাকে কেউ অপবিত্র ভাববে মনে করতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। কিছুই বলা হল না।

পাগলের মত ঘুরে বেড়াই। কোথাও তিষ্টোতে পারি না। নাজিমের বৌ আমাকে জোর করে একটু খাওয়ায়। সেদিন হাসিনা কাজে ব্যস্ত থাকায় নাজিম আমার জন্য খাবার এনেছে। আমি খেতে না চাইলে, জোর করছে। এমন সময় কেউ ঘরের দরজায় বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। আমি ও নাজিম দুজনেই অবাক! এটা কি হল? পরক্ষণেই হাসানের গলা পাওয়া গেল। সঙ্গে অনেক লোক। ওরা এসে দরজা খুলল। গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গ খেলে গেল। সবাই আমাদের ঘিরে ধরল।

 

- দ্যাখো! মেয়েটার মরা দশ দিনও হয় নাই। এর মধ্যে এই! আমি বলিনি? মাগী নাজিমের সাথে ঢলাঢলি করে। মেয়েটাও কোথা থেকে পেট বাঁধিয়ে সেটা খসাতে গিয়েই তো মল! আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করছিলে না? এবার নিজের চোখে সব দ্যাখো। হাসান ভরা মজলিসে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল।

 

হাসানের চক্রান্ত বুঝতে আমার দেরি  হল না। সে বুঝেছে আমার এখন হারাবার কিছু নাই। আমি যে কোন সময় মুখ খুলতে পারি। কেন যে এখনো খুলিনি সেটা নিয়ে তার মনে ধন্দ তৈরি হয়েছে। সে ভাবছে নাজিমকে সঙ্গে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছি। লোক জানাজানি হলে মাথা হেঁট তো হবেই, উপরন্তু জমিটা ফিরিয়ে দিতে হবে। আমার মুখ দিয়ে  কোন কথা বের হল না। আমার সব কথা বুঝি শেষ হয়ে গেছে। বেচারি নাজিম! তার কথা কেউ বিশ্বাস করল না। যে যেমন ভাবে পারল কিল, চড় মারতে লাগল তাকে। সঙ্গে দুজনকে নিয়ে চলল অশ্লীল গালি গালাজ। সদ্য সন্তান হারা বলে হয়তো দয়া পরবশ হয়ে আমার গায়ে হাত দিল না। এরপর আরো বাকি ছিল। দু জনেরই মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম থেকে বের করে দিল। সাবধান করে দিল গ্রামে ঢুকলে প্রাণে মেরে দেবে।

 

নাজিম কি করল জানি না। আমি ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশনে নামলাম। স্টেশনেই পড়ে থাকি। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় প্রাণটা শেষ করে দিই। কিন্তু তাহলে যে এত বড় অন্যায়ের শাস্তি হবে না! হাসানকে শাস্তি না দিয়ে আমি মরতে পারি না। পরনে ময়লা কাপড়। জুটলে খাই নইলে উপোশ। সবাই পাগলী বলে ডাকে। দিন রাত হাসানকে মারার ছক কষি। যেমন করেই হোক একটা ছুরি যোগাড় করতে হবে। তারপর রাতের অন্ধকারে গাঁয়ে ঢুকে তাকে শেষ করব। কিন্তু ছুরি কোথায় পাই? একদিন সু্যোগ এসে গেল। এক ফলওয়ালার অন্যমনস্কতার সুযোগে তার ছুরিটা তুলে নিলাম। দেখতে পেয়ে ছুরিটা কেড়ে নিতে গেলে আমার সাথে ফলওয়ালার ধস্তা ধস্তি শুরু হল। আমার হাতের ছুরি তার হাতে লাগল। ফিনিকি দিয়ে রক্ত ছুটল। পুলিস আমাকে ধরে লক আপে ঢুকিয়ে দিল। পায়ে হাতে ধরে বললাম- আমাকে একবার ছেড়ে দাও, শয়তানটাকে শেষ করে আসি। তারপর আমার ফাঁসি দিও। কেউ শুনল না। অনেকদিন ওখানে ছিলাম। তারপর  তারা আমাকে এখানে রেখে গেল। এখানেও আমার যন্ত্রণার কথা কেউ বোঝে না। আমার কথা ছেড়েই দিলাম। আমার ফুলের মত মেয়েটা কলঙ্ক মাথায় নিয়ে কবরে গুমরে গুমরে কাঁদছে। আর সব দোষের দোষী সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। এ আল্লার কেমন বিচার? আমি কিচ্ছু চাইনা। শুধু একটা ছুরি। তাও আমাকে কেউ দেয় না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকল রেহেনা।

  

ছুরি পেলেই কি রেহেনা নেকড়েটাকে মারতে পারবে? নেকড়েরা খুব চালাক প্রাণী। ওরা ঠিক বেঁচে যায়। সুরক্ষিত সুড়ঙ্গে অনায়াসে নিজেদের লুকিয়ে ফেলে, পরবর্তী শিকারের জন্য দাঁত নোখ শানায়। সেখানে পৌঁছানোর সাধ্য রেহেনাদের হয় না। তাদের বিধিলিপি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা- হনন, আত্মহনন কিম্বা হোমের বন্ধ দরজায় নিষ্ফল মাথা কুটে মরা।

লেখক : ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment